কবিতায় দর্শন
কবিতা
সাধারণত নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণে উল্লেখিত নয় এবং জ্ঞান চর্চার এমন কোনো শাখা
নেই যেখানে কবিতা অনায়াসে বিচরণ বা গমন না করতে পারে ।তাই কবিতার মধ্যে সবকিছুকে
অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বলা যেতে পারে কবিতা সর্বত্রগামী এবং সমস্ত বিদ্যা এবং
অধিবিদ্যার নিরিখে সে অনির্দিষ্ট থেকে যায়।
Philosophy থেকে দর্শন কথার আগমন যা হল love to wisdom. প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসাই হল দর্শন। ফিলোসপি শব্দটি
এসেছে প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে। মূলত ফিলোস এবং সোফিয়া শব্দ থেকে এই ফিলোসফি
শব্দের ব্যুৎপত্তি। ফিলোস হল ভালোবাসার পাত্র এবং সোফিয়া হল প্রজ্ঞা। তাই এটা
পরিষ্কার যে দর্শন হল প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসা। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে জ্ঞান
এবং প্রজ্ঞা এক জিনিস নয়। তথ্য এবং ঘটনা সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা থেকে জ্ঞান লাভ
করা যায়। কিন্তু দর্শন সেই জ্ঞানের উপর শুধু নির্ভর করে না। জ্ঞানের সাথে মানুষ ও
প্রকৃতির বিভিন্ন যে সম্পর্ক এবং সম্পর্কজনিত নানান দিক - এ সবের চর্চা এবং অনুসন্ধানই হল দর্শনের ক্ষেত্র। দর্শনের
ব্যুৎপত্তি সুপ্রাচীনকালে যখন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আজকের থেকে অনেক অপরিপক্ক ছিল
তখন চিন্তার মূল সহায়ক ছিল কল্পনা এবং সজ্ঞা।
দর্শনের যে বিভিন্ন শাখা আছে তা
হল জ্ঞানতত্ত্ব , নন্দনতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র , যুক্তিবিদ্যা ,
অধিবিদ্যা , রাজনৈতিক দর্শন এবং বিভিন্ন
ধর্মীয় দর্শন। দর্শন নিয়ে যে বিভিন্ন
মতবাদ তৈরি হয়েছে তাদের দুটো ভাগ তা হল ভাববাদী দর্শন এবং বস্তুবাদী দর্শন।
ভাববাদী দর্শনে সাধারণ মানুষের সরাসরি অস্তিত্বের চেয়ে সামগ্রিকতায় বেশি জোর
দেওয়া হয় কিন্তু বস্তুবাদী দর্শনে মানুষের নিজস্ব চাহিদা এবং নিজস্ব অস্তিত্বের
কথা স্বীকার করা হয় এবং তা নিয়ে চিন্তার ক্ষেপন চিন্তার আছে। কবিতার সাথে সরাসরি
সম্পর্কিত দর্শনের যে শাখা তা হল জ্ঞানতত্ত্ব এবং নন্দনতত্ত্ব।
জ্ঞানতত্ত্বে আমরা দেখি জ্ঞানের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা কীরকম। আমরা যে সমস্ত
তথ্য জানি তা কীভাবে জানতে পারলাম। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা কী কী। আমাদের
আশেপাশে যে আরো মনোজগত্ আছে তা আমরা কীভাবে জানতে পারব। এইভাবে আমরা জানতে পারি
আমাদের দৃশ্যমান জগতের বাইরে একটি জগত আছে এবং এ সম্পর্কে নির্ধারিত প্রমাণ।
নন্দনতত্ত্বে আলোচনার বিষয় হল শিল্প কী, মানুষের রুচির
মানদণ্ড কী; শিল্প কি অর্থপূর্ণ, যদি
তাই হয় তাহলে শিল্পের অর্থ কী ? উত্তম শিল্প কী, শিল্প কি একটি সমাপ্তির কারণ নাকি শিল্প নিজের প্রয়োজনে নিজেই উদ্ভাসিত।
কী আমাদের শিল্পের সাথে সংযুক্ত
করে; কীভাবে শিল্প আমাদের প্রভাবিত করে। শিল্প কি সমাজকে
উপরে ওঠাতে বা নীচে নামাতে পারে।
আমরা মনে করি কবিতা হল spontaneous overflow of emotions। একজন কবি যখন
কবিতা লেখেন তখন তাঁর মধ্যে তৈরি হওয়া একধরনের আবেগের সংক্রমণ বা কম্পনজনিত
শব্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং তিনি কবিতা লেখেন। সমাজ থেকে , সমাজের মূল্যবোধের অবস্থান থেকে তিনি কলম ধরতে
পারেন অথবা তাঁর মধ্যে তৈরি হওয়া নান্দনিক ঝোঁক বা crisis তাঁকে
বাধ্য করে লিখতে। আসলে কবির মধ্যে এক ধরনের রসায়ন থাকে যা তাকে শব্দ জোগান দেয় । কবির বাইরেও সমস্ত মানুষের মধ্যে দর্শনভাব থাকে। একজন কবি যখন
লেখেন তখন তাঁর সামনে থাকে অভিজ্ঞতাজনিত দৃশ্যপট, অদৃশ্যজগতের উপস্থিতি, secretion in
hypothalamus, মস্তিষ্ক-মেধা-চিন্তনের সাথে যোগসূত্রের বিক্রিয়াজনিত outburst এবং তার অনুভবির impulse।
কবির কবিতা চয়ন স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে , স্বতঃস্ফূর্ততার স্রোত ব্যহত
করে, শব্দ সন্ধানের দিকে ঝোঁক হতে পারে ( বিশেষ করে ছন্দ প্রয়োগ ও লেখনের ক্ষেত্রে ) আবার
দীর্ঘসময়ের লালন বা যাপনের মধ্যে দিয়ে কবিতার নির্মাণ ক্রিয়া। কাজেই কবিতা লেখার
প্রাক মুহূর্তে কবিতা যেভাবে লেখা বা নির্মাণ হয় তা সর্বক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি
ধারা বা বিষয় সাপেক্ষে বা কোনো গভীর দর্শন চিন্তার সাপেক্ষে নাও হতে পারে। কিন্তু
কবিতা রচনা হয়ে যাওয়ার পর আগত শব্দ সমূহের সামগ্রিক বাঁধন এবং বিচ্ছুরণ থেকে
দর্শন শাখার জ্ঞানতত্ত্ব ও
নান্দনিক তত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে তা স্বতন্ত্র ভাবে দাঁড়াতে পারে। একটি কবিতা
থেকে আমরা আলোচনা করতেই পারি কীভাবে সেই শিল্প বাস্তবজগত, পরাবাস্তব
জগত অথবা নীতিশিক্ষা বা রাজনৈতিক দর্শনের প্রেক্ষিত তুলে ধরে। ফলে কবিতাকৃত কবিতা
বা শিল্পের মধ্যে কবির জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে দর্শনবোধ চলে আসেএবং সেই দর্শন বোধ
নিয়ে আসা বা চলে আসার ক্ষেত্রে কবিতার বা কবির মনোজগতের সাথে চিন্তনের উত্তরণের
সক্রিয়তা থাকতেই হবে। না হলে যে কোনো কবিতাই দর্শনের গভীরতা নির্ণয় করতে পারবে না
বা focus দিতে পারবে না । এর জন্য দরকার অভিজ্ঞতা, আরোহণ, শৈল্পিক নিপুণতা,
মেধা, জারণ, কল্পনার অধ্যাদেশ এবং চেতনা।
কাজেই এটা
পরিষ্কার যে, সমস্ত কবিতার মধ্যেই দর্শনের আলতো ছোঁয়া থাকলেও, সেই ছোঁয়া খুব গভীরে গিয়ে কাজ করতে আরম্ভ করার
জন্য বা দর্শনের অন্তর্গত নিগূঢ়তা তুলে ধরার জন্য কবি এবং কবিতাকে নির্দিষ্ট
হাইটে উঠতেই হবে । তবেই সেই কবিতা হয়ে উঠবে দর্শন বা প্রজ্ঞার খোঁজের দিশা ।নচেত কবিতার
ভিতর সেই প্রজ্ঞার অনুপস্থিতি থেকেই যাবে । অর্থাত্ কবিতায় কবি কী বলতে চাইছেন কেন
বলতে চাইছেন এর পাশাপাশি কবিতা হয়ে ওটা ও একটা বড়ো factor।
বর্তমানে কবিতা যে ভাবে বদলাচ্ছে তার
আঙ্গিক, ভাষার দাপট এবং প্রকরণ সেক্ষেত্রে কবির মূল
উদ্দেশ্যই হচ্ছে কবিতাকে তার পুরাতন অবস্থান থেকে বদলানো এবং এই বদলানোর
প্রক্রিয়া চলছে এক ঝাঁক এই সময়ের কবির মধ্যে। সত্তরের পর কবিতা বাঁক নিয়েছে
প্রতি দশকে। হয়তো কখনও ধীর, কখনও দ্রুত। কিন্তু এই দ্বিতীয়
দশকে বেশ কিছু কবি তাঁদের লেখনীর মধ্যে physics chemistry maths সহ বিভিন্ন experiment তা সে কাঠামোগত হোক বা ভাষাগত,
প্রচেষ্টা জারি রেখেছে। এইসব কবিতার মধ্যে দর্শনের প্রকটতার থেকেও
ভাষাগত শব্দগত আঙ্গিকগত পরিবর্তনই বেশি লক্ষণীয় এবং ভিতরে ভিতরে এক ধরনের crisis
পরিলিক্ষত। তাই বলে এ সব লেখা যে কবিতা নয় - তা কে বলবে। বরং বলা চলে কবিতাকে শিল্প হিসেবে দেখে সেই শিল্পকে
তার অন্তর্গত দৃষ্টতার সাথে পরিবর্তন করাই লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে দর্শন বলতে কবিতার
শৈল্পিক তত্ত্ব বা দর্শনের নান্দনিক তত্ত্বই বেশি উদ্ভাসিত। যে লেখা ভিতর থেকে
স্বতঃস্ফূর্ত বেরিয়ে আসে তা তো শিল্প। শিল্পের মধ্যে যে চেতনাবোধ থাকে, সেই চেতনাবোধের মধ্যে দর্শন বা প্রজ্ঞার খোঁজ
বিরাজমান। কাজেই বেশিরভাগ কবিতার মধ্যেই কিছু না কিছু খোঁজ চলতেই থাকে যদি তা
সারবত্তাবিহীন নিছক শব্দের সমাহার না হয়।
প্লেটো নিজে
এক দার্শনিক হয়েও,
তাঁর দৃষ্টিতে রাষ্ট্র থেকে কবিদের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। তাহলে
কি তিনি কবিতার মধ্যে দর্শন চিন্তার কোনো কিছুই দেখতে পাননি। হতে পারে তখন কবিদের
ভাবনার সাথে সামগ্রিক দেশের বা এথেন্সের উন্নতি বা রাষ্ট্রের উন্নতির সামঞ্জস্য
তিনি দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই ধারণা বদলে যায়।
দার্শনিক হাইডেগার আবার বলেছেন - ধর্মযাজক বা বিজ্ঞানীরা নয় বরং কবি ও চিন্তাবিদরাই নতুন ভাষা গ্রহণোম্মুখ এবং তাঁরাই বিরাজনের নতুন উপায়কে অগ্রসর করাতে পারেন এবং স্থায়িত্ব দিতে পারেন। সুতরাং ভবিষ্যতে কোনো অব্যক্তিক, অস্বেচ্ছাচারী নতুন বিশ্ব পাবার ক্ষেত্রে তাঁরাই একমাত্র ভরসা।
জিনিসপত্রকে এভাবে
বিভিন্ন উপায়ে সজ্জিত করাকেই তিনি আলোচনা ( discourse ) বলেছিলেন। যে পরিস্থিতির মধ্যে আমরা
নিজেদের আবিষ্কার করি তাকে নতুন রূপ দেওয়াই আলোচনা এবং সেই আলোচনার অনেক মাধ্যম
রয়েছে যার মধ্যে কথা একটি।
কাজেই কথা দিয়ে কবিরা যে শিল্প গাঁথেন তার মধ্যেই
থাকে পারিপার্শ্বিকতার সাথে, অলীক বা অদৃশ্য জগতের সাথে এবং দৃশ্যমান জগতের
সাথে আলাপচারিতা এবং এই আলাপচারিতার মধ্যে যে খোঁজ বা প্রজ্ঞার খোঁজ থাকে সেই
খোঁজই হল দর্শন। কবি তাঁর লেখনীর মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে দার্শনিক প্রজ্ঞা লাভ করেন। দর্শন শুধু স্কুল বা কলেজের পড়ারই বিষয় নয় বা অল্প কতক পন্ডিতের
হাতেই সীমাবদ্ধ নয়,
বরং তা সমাজ ও সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা যাপনের অংশ। প্রত্যেকটা সমাজ,
দেশ ও সম্প্রদায়ের দর্শন রয়েছে সেটা নিজের হোক বা ধার করা হোক, শক্তিশালী হোক বা দুর্বল, কেউ জানুক বা না জানুক দর্শন তাকে নিয়ন্ত্রিত করে। দর্শনকে আসলে অনেক অনেক প্রশস্ত সামিয়ানা বা সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখে
থাকে। এ ক্ষেত্রে আসলে ব্যক্তির অবস্থান এটা নির্ণয় করে দেয়। মানুষ আসলে ততটুকুই
দেখে যতটুকু তার ক্ষমতা আছে বা ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করে।
দর্শনের মহান শিক্ষক বাট্রান্ড রাসেল মনে করেন দর্শনের সীমানা ধর্মতত্ত্ব ও
বিজ্ঞানের মাঝামাঝি " no man's land " এ। সব নিশ্চিত জ্ঞান বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত। এই নিশ্চিত জ্ঞানের বাইরে যে
জগত সেখানটাতেই দখলদারিত্ব করে ধর্মতত্ত্ব। এই নিশ্চিত জ্ঞান ও অনিশ্চিত জগতের
মাঝে যে জায়গাটা সেটা দর্শনের মধ্যে বিবেচ্য। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারে না
বিজ্ঞান বা ধর্ম তত্ত্বের উত্তর মনোপুত হয় না সেগুলো নিয়েই কারবার দর্শনের।
দর্শনের কিছু চিন্তার প্রশ্ন হচ্ছে - আমি কে? এই মহাবিশ্বের কোনো উদ্দেশ্য আছে কি? মানুষের জীবনটা কেমন , জীবনের ফলাফল বা
অর্জন কি একটা বিশাল শূন্য। প্রজ্ঞা বলতে কি কোনো জিনিস আছে ? না কি সেটাও আমাদের
অজ্ঞতার পরিপূর্ণ বিকাশ? সত্য বলে কি কোনো পথ আছে , না কি সত্য পথও
অন্ধকারেই ধাবিত হয়।
এই যে এত প্রশ্ন এগুলো বিজ্ঞান দিতে পারে না এবং ধর্মীয় উত্তরও আমাদের আলোকপ্রাপ্ত মন মেনে
নিতে পারে না। এই সব প্রশ্নগুলোকে অধ্যয়ন করা দর্শনের কাজ। একজন কবি তো তাঁর
বিষ্ময়াভিভূত ও জাগ্রত চোখ দিয়ে এ সব প্রশ্নের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কবিতা লেখেন
শব্দ চয়ন করেন । তাঁর কবিতায় থাকে জাগতিক বিষয় আবার অতিজাগতিক বা অদৃশ্য বিষয়।
কাজেই তাঁর সেই প্রজ্ঞার খোঁজ বা প্রজ্ঞার প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে শব্দের
প্রবাহমানতার নিরিখে অগ্রসর হওয়া তো এক প্রকার প্রজ্ঞার ই অন্বেষণ। তাই সব কবিতার
মধ্যে না হলেও, বেশির ভাগ কবিতাতে দর্শন চিন্তা কিছু না কিছু থাকে
যদি কবিতা নিছক ছেলেখেলা পর্যায়ের অনুত্তীর্ণ না হয়। সব কবিতা যে দর্শন পথ খুঁজে
পাবে তা নয়, তবে অনুভূতির অবগাহনে কবির মধ্যে চলে দিব্যজ্ঞান
খোলার উন্মেষ।
** ছবিঋণ ঃ ওয়াসলি ক্যান্ডিনস্কি
** ছবিঋণ ঃ ওয়াসলি ক্যান্ডিনস্কি
No comments:
Post a Comment